***** অপেক্ষা *****

***** অপেক্ষা *****
..
সন্ধ্যাটা গড়িয়ে কখন যে রাত হয়ে গেলো টের-ই পায়নি নীড় । ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো রাত ১০ টা বাজে। আজকে অফিসের কাজের চাপে ঘড়িটার দিকে তাকানোর সময় ও হয়নি। মাত্র কাজ শেষ করে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লো বাসার উদ্দেশ্যে। 
..
কিছুক্ষণ পরে বাসায় এসে, ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে গেলো। হঠাত একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলো। রিসির্ভ করলো,কিন্তু ওপাশ থেকে কোন কথা নেই। অতঃপর কলটা কেটে গেলো। নীড়ের আবার ফেরত কল করার অব্যাস একদম নেই। তাই আর কলটা ফেরত করা হয়নি। 
..
আজকের আকাশটা অনেক সুন্দর লাগছে, যেন অনেক তারার ঝিলিক বাতিতে সাজানো। চারদিক নিরব, দূর- দূরান্তে ও কোন সাড়া নেই। রাস্তার ধারের নিয়নের আলো গুলো ও মিটি মিটি জ্বলছে। হঠাৎ আবার ফোনটা বেজে উঠলোঃ
..
--- হ্যালো, কে?
--- আপনি আমায় চিনবেন নাহ। কেমন আছেন?
--- আগে বলুন আপনি কে?
--- বল্লাম নাহ, চিনবেন নাহ। কেমন আছেন সেটা বলুন।
..
( কন্ঠটা প্রথমবার শুনেই চিনতে বাকি নেই নীড়ের। এটা তার সেই পরিচিত কন্ঠস্বর, যেটা না শুনলে নীড়ের একটা সময় ঠিক ভাবে ঘুম হতো নাহ )
..
--- আছি নিজের মত করে।
--- আমি কেমন আছি জিজ্ঞাস করবেন নাহ?
--- নাহ, কিছু মানুষ সব সময়-ই ভালো থাকে।
--- ওহ, তার মানে আমায় চিনতে, পেরেছো।
--- হুম।
--- তিন বছর পর আজ তোমার নাম্বারটা খোলা পেলাম। এতো দিন বন্ধ ছিলো কেনো?
--- এমনি।
--- আচ্ছা,তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে বিরক্তিবোধ করছো? নাকি আমার উপরে রেগে আছো?
--- বিরক্তি বোধ করছি কিনা জানিনা, তবে রাগ নেই, কারণ তোমার উপরে রাগের কোন অধিকার আমার নেই, যদিও এক সময় ছিল।
..
হঠাৎ কলটা কেটে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কল ফেরত দিলো, কিন্তু নীড়ের তো মোবাইলের টাকা শেষ, রাত বেশী হয়ে যাওয়ায় টাকা ডুকানোর কথা মনেই ছিলো নাহ।
..
৩ বছর পরে আজ হঠাৎ কেনো যেনো আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। নিয়ণের আলোতে চেয়ে থাকা প্রতিটি অসহায় দিন গুলো ও কেনো যেনো আজ আবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।
..
নীড় সে দিন ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতে যাবে, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে ছাতা মাথা দিয়ে রাস্তায় এলো। এসেই একটা রিক্সা নিয়ে সোজা বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। হঠাৎ কিছু দূর যাওয়ার পরে-ই নীড় লক্ষ করলো, রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। কিছুটা ভিজে গেছে, তবে দেখে-ই বুঝা যাচ্ছে, মেয়েটার প্রচুর ঠান্ডা লাগছে, কারণ ওর শরীরটা কাঁপছে। এটা দেখেই নীড় রিক্সা থেকে নেমে মেয়েটির কাছে গিয়ে,কোনো কথা না বলেই ছাতাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে এক দৌড়ে এসে রিক্সায় উঠলো। মেয়েটি হয়তো কিছু বলতে চেয়ে ছিলো, কিন্তু কোন সুযোগ না দিয়েই সোজা এসে বাসায় উঠলো নীড়।
..
পরের দিন ক্যাম্পাসে যেতেই নীড় দেখলো তার বন্ধুরা সবাই, গ্রুপে আড্ডা দিচ্ছে। পাশে একটা গিটার ও আছে, কিন্তু কেউ-ই বাজাচ্ছে নাহ। নীড়ের আবার একটা অব্যাস গিটার দেখলেই গান গাইতে ইচ্ছা করে। ছোট বেলা থেকেই নীড়ের গানের প্রতি বেশ ঝোঁক রয়েছে। কিন্তু কারো সমর্থন পায়নি বলেই বেশী দূরের পথ ভাবা হয়নি এটা নিয়ে। তবে, তার বন্ধু বান্ধবা কিন্তু আবার তার গানের অনেক বড় ফ্যান।
..
শেষ পর্যন্ত আড্ডা শেষ করে সবাই সবার ক্লাসে যেতে লাগলো। কিন্তু নীড় এই বিষয় ক্লাস করবে নাহ, তাই সে মাঠে বসে সবুজ ঘাসের উপরে শুয়ে আছে। হঠাৎ, একটা মেয়ে এসে পাশে বসেঃ
--- হ্যালো, কেমন আছেন?
--- জ্বি ভালো, আপনাকে ঠিক চিনলাম নাহ?
--- ওভাবে দৌড়ের উপর থাকলে চিনবেন ও বা কিভাবে?
--- মানে?
--- আরে, ওই দিন আপনি আমায় বৃষ্টির মাঝে ছাতা দিলেন যে।
--- ওহ, মনে পড়েছে, কেমন আছেন?
--- ভালোই। তো ওই দিনের ব্যাপারটা কি আমার প্রতি করুণা ছিলো? নাকি সব মেয়েদের দেখলেই এমন করেন?
--- দুটোর একটাও নয়। বিপদে পড়া মানুষটাকে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করেছি, শুধু এটাই।
--- ওহ, ভালো। তবে যা-ই বলেন ওই দিন আপনি যে আমার কত বড় উপকার করেছেন বলে বুঝাতে পারবো নাহ। বাই দা ওয়ে, আপনার গানের কন্ঠ অনেক সুন্দর।
--- ধন্যবাদ, যাই হোক আপনার সাথে তো পরিচয় হয়নি।
--- আমি পৃথিবী। ১ম বর্ষে পড়ি (পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ)।
--- ওহ, আমি নীড়। ৩য় বর্ষ (ইংরেজী)।
..
এভাবেই শুরু হয়েছিলো নীড় এবং পৃথিবীর বন্ধুত্ব, আর কিছু দিনের মধ্যেই সেটা ভালোবাসায় রূপ নেয়।
..
কিন্তু, হঠাৎ একদিন পৃথিবীর অ মতে-ই তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে । তখন পৃথিবী তার পরিবার কে নীড়ের কথা বলে ছিলো, কিন্তু তার কথার কোন মূল্য পায়নি সে। বরং তাকে বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ করে দিয়েছে এবং তার মোবাইল টাও কেড়ে নিয়েছে। যার জন্য কয়েক দিন ধরেই পৃথিবীর সাথে কথা হয়নি নীড়ের। খোঁজ নিতে পৃথিবীর বাসার নিচে যেতেই দেখলো বর-যাত্রীরা বউ নিয়ে চলে যাচ্ছে। বউটা আর কেউ নয়, পৃথিবী-ই।
..
চোখ দিয়ে সেদিন নীড়ের জল ঝরে ছিলো শুধু।
মোবাইলটাও কোথায় সেদিন হারিয়ে পেলেছিলো। তারপর আর সিমটা তোলা হয়নি।
..
তখন থেকে নীড়ের প্রতিটা রাত কেটে ছিলো আঁধারে, ঘরের কোনো এক কোনায়। 
..
আজ ৩ বছর পর সিমটা তুললো নীড়, কিন্তু তুলতেই পৃথিবীর কল। তার মানে কি মেয়েটা আজ ৩ বছর ধরেই প্রতিটা দিন-ই নীড়ের নাম্বারে কল দিয়ে ছিলো?
..
সারারাত আর ঘুম হয়নি। সকাল ৭ টা বাজেই পৃথিবীর ফোন। রিসির্ভ করতেইঃ
--- কই তুমি?
--- বাসায় কেনো?
--- এখনি লেকের ধারে আসো।
..
কোন কথা না বলেই, সোজা লেকের ধারেই চলে গেলো সে। গিয়ে দেখলো, সাদা জামা পড়া একটা মেয়ে বসে আছে,মেয়েটা ঠিক আগের মত-ই সুন্দর আছে। কিন্তু চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে কিছুটা। 
..
তার কাছে যেতেইঃ
--- এতো দেরী হলো যে?
--- নাহ, রাস্তায় জ্যাম ছিলোতো।
--- ওহ, কেমন আছো?
--- ভালো, তুমি?
--- ভালোই। কি করছো আজকাল?
--- এইতো, একটা কোম্পানিতে ম্যানেজার পোস্টে আছি। তুমি?
--- আমি একটা গার্মেন্টস এ চাকরি করছি।
--- গার্মেন্টসে চাকরি করছো মানে?
..
কথাটা শুনে মেয়েটি কেঁদে উঠে, গত ৩ বছরে কি ঘটে ছিলো তা খুলে বল্লো নীড়কেঃ যে দিন পৃথিবীর বিয়ে হয়েছিলো ঠিক সেদিন রাতেই সে তার শশুর বাড়ী থেকে পালিয়েছে, সে দিন পালানোর পরে নীড়কে কল দিয়ে ছিলো কিন্তু নীড়ের ফোন বন্ধ ছিলো। সে দিন আর পৃথিবী তার বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার সাহস পায়নি। তাই কোন ভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই গার্মেন্টসের চাকুরিটা খুঁজে নিয়ে ছিলো। গত ৩ বছর যাবত নীড়কে প্রতিদিন কল দিয়ে ছিলো, কিন্তু একটা বারো ফোনটা খোলা পায়নি। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পর কাল খোলা পেলো।
..
নীড়ের আর কিছু বলার সামর্থ্য ছিলো নাহ,সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। নীড়ের হয়তো তখন আর বুঝতে বাকি ছিলো নাহ,পৃথিবীর চোখের নিচে কালো দাঁগ পড়েছে কেনো।
.
আর এভাবেই শেষ হয়ে ছিলো আরো একটি অপেক্ষার গল্প।

Comments

Popular posts from this blog

গল্পঃ অবহেলিত ভালোবাসা

কিছু মানুষ ভালোবাসার কাঙ্গাল

~তোমার দেয়া একটি উপহার